টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের হয়—

  1. টাইপ-১ ডায়াবেটিস: এটি একটি অটোইমিউন (Autoimmune) রোগ, যেখানে শরীর নিজেই ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোর (Beta Cells) ক্ষতি করে। ফলে শরীর একদমই ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।
  2. টাইপ-২ ডায়াবেটিস: এটি ইনসুলিন প্রতিরোধজনিত (Insulin Resistance) রোগ, যেখানে শরীর ইনসুলিন তৈরি করলেও তা ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস

কী হয়? – অগ্ন্যাশয় (Pancreas) পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।
কারণ – এটি অটোইমিউন ডিজিজ, অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোর ওপর আক্রমণ করে।
কারা বেশি আক্রান্ত হয়? – সাধারণত শিশু, কিশোর ও তরুণরা বেশি আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ

  • হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া
  • অতিরিক্ত তৃষ্ণা ও বারবার প্রস্রাব
  • দুর্বলতা ও অবসাদ
  • ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া
    চিকিৎসা – ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া বাধ্যতামূলক।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস

কী হয়? – শরীর ইনসুলিন তৈরি করলেও এটি কার্যকরভাবে কাজ করে না, ফলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়।
কারণ

  • ইনসুলিন প্রতিরোধ (Insulin Resistance)
  • অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
  • ব্যায়ামের অভাব
  • বংশগত কারণ
    কারা বেশি আক্রান্ত হয়? – সাধারণত ৩০-৪০ বছর বয়সের পর মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়, তবে বর্তমানে তরুণদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।
    লক্ষণ
  • শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত লাগা
  • দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া
  • ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
  • বারবার সংক্রমণ হওয়া
    চিকিৎসা
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
  • নিয়মিত ব্যায়াম
  • ওষুধ (যদি প্রয়োজন হয়)
  • কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন প্রয়োজন হতে পারে

টাইপ-১ বনাম টাইপ-২ ডায়াবেটিস: পার্থক্য

বৈশিষ্ট্য টাইপ-১ ডায়াবেটিস টাইপ-২ ডায়াবেটিস
ইনসুলিন উৎপাদন একেবারে হয় না হয়, কিন্তু কার্যকর নয়
প্রধান কারণ অটোইমিউন সমস্যা ইনসুলিন প্রতিরোধ, স্থূলতা, জীবনধারা
বয়স সীমা সাধারণত শিশু ও তরুণরা আক্রান্ত হয় সাধারণত ৩০+ বছর বয়সে হয়
চিকিৎসা ইনসুলিন ইনজেকশন বাধ্যতামূলক জীবনযাত্রা পরিবর্তন, ওষুধ, কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিন
প্রতিরোধযোগ্য? প্রতিরোধ সম্ভব নয় স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব

উপসংহার

  • টাইপ-১ ডায়াবেটিস মূলত জন্মগত বা অটোইমিউন সমস্যার কারণে হয় এবং ইনসুলিন ইনজেকশন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
  • টাইপ-২ ডায়াবেটিস মূলত জীবনযাত্রার কারণে হয় এবং ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের খাবারের তালিকা

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সুস্থ, পরিমিত ও কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও চিনি এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রোটিন, ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ বাড়াতে হবে।

খাবারের চার্ট (সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত অনুযায়ী)

সময় খাবার
সকাল (৭:০০ – ৮:০০ AM) ১ গ্লাস মিশ্রিত দুধ (গরম দুধ + ১ চা চামচ মেথি ভেজানো পানি) + ১টি সিদ্ধ ডিম + ৫-৬টি বাদাম (আমন্ড/আখরোট/কাজু)
সকালের নাশতা (৯:০০ – ১০:০০ AM) আটা/ওটস রুটি (১টি) + সবজি + টক দই অথবা ডালিয়া (মিষ্টি ছাড়া) + ১টি কমলা/পেয়ারা
মাঝে ছোট খাবার (১১:০০ AM) ডাবের পানি/লেবুর শরবত (চিনি ছাড়া) + মুষ্টিমেয় বাদাম ও ছোলা
দুপুরের খাবার (১:০০ – ২:০০ PM) বাদামি চালের ভাত/লাল চালের ভাত (১ কাপ) + মাছ/মুরগির মাংস (১ টুকরা) + মুগ ডাল + সবজি (শাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া)
বিকেলের নাশতা (৪:০০ – ৫:০০ PM) ফল (আপেল/পেয়ারা/কমলা/জাম) + বাদাম ও ছোলার মিশ্রণ + গ্রিন টি (চিনি ছাড়া)
রাতের খাবার (৮:০০ – ৯:০০ PM) রুটি (১-২টি, আটার) + মুগ ডাল + সবজি + মাছ/ডিম
ঘুমানোর আগে (১০:০০ – ১১:০০ PM) ১ গ্লাস দুধ (চিনি ছাড়া) + ২টি খেজুর (সীমিত পরিমাণে)

যা খাবেন ✅

  • উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার (শাকসবজি, ডাল, বাদাম)
  • কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ফল (আপেল, পেয়ারা, জাম)
  • লো-ফ্যাট প্রোটিন (মাছ, মুরগি, ডাল, ডিম)
  • স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (বাদাম, অলিভ অয়েল, নারকেল তেল)

যা এড়িয়ে চলবেন ❌

  • সাদা চাল ও ময়দার তৈরি খাবার (সাদা ভাত, পরোটা, লুচি)
  • মিষ্টি ও অতিরিক্ত চিনি (মিষ্টি, সফট ড্রিংক, মধু বেশি)
  • অতিরিক্ত লবণভাজাপোড়া খাবার
  • প্রসেসড ফুড (বিস্কুট, নুডলস, ফাস্ট ফুড)

নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম করুন (ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে)
চিনি ও কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ করুন
ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তের সুগার পরীক্ষা করুন

এই ডায়েট অনুসরণ করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত হবে।

 

ডায়াবেটিস কী এবং এ রোগ কেন হয়

ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস (Diabetes) হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি (Chronic) রোগ, যেখানে শরীরের রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এটি ইনসুলিন হরমোনের সমস্যা বা অকার্যকারিতার কারণে ঘটে।

  • ইনসুলিন হলো অগ্ন্যাশয় (Pancreas) থেকে নিঃসৃত একটি হরমোন, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং এটি কোষে পৌঁছে দেয় শক্তি উৎপাদনের জন্য।
  • ডায়াবেটিস হলে শরীর হয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অথবা উৎপন্ন ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট, কিডনি, চোখ ও স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে।

ডায়াবেটিস কেন হয়?

ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ ইনসুলিনের ঘাটতি বা অকার্যকারিতা। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন—

১. জেনেটিক্স বা বংশগত কারণ

  • পরিবারে যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • বিশেষত টাইপ-১ ডায়াবেটিস সাধারণত বংশগত কারণে হয়ে থাকে।

২. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

  • অতিরিক্ত চিনি ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বেশি খেলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
  • প্রসেসড ফুড, সফট ড্রিংকস, জাঙ্ক ফুড বেশি খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

৩. স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন

  • অতিরিক্ত ওজন হলে শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা (Insulin Sensitivity) কমে যায়, ফলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়।
  • পেটের চারপাশে বেশি চর্বি থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়

৪. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা (ব্যায়ামের অভাব)

  • পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করলে শরীর ইনসুলিনকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, ফলে রক্তে শর্করা জমে।
  • নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

৫. মানসিক চাপ ও ঘুমের সমস্যা

  • দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ কর্টিসল (Cortisol) হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ইনসুলিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

৬. হরমোনজনিত সমস্যা

  • পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে।

৭. কিছু ওষুধ ও মেডিকেল অবস্থার প্রভাব

  • কিছু স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে রক্তে শর্করা বাড়াতে পারে।
  • দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে

উপসংহার

ডায়াবেটিস সাধারণত ইনসুলিনের ঘাটতি বা অকার্যকারিতার কারণে হয়। বংশগত কারণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ব্যায়ামের অভাব, মানসিক চাপ, হরমোনের সমস্যা ও কিছু ওষুধ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে এই রোগ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।