শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধিতে সাহায্যকারী খাবার ও জীবনযাত্রা

 

শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য শুধুমাত্র জিনগত কারণই দায়ী নয়, সঠিক পুষ্টি ও জীবনযাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বয়স অনুযায়ী সঠিক খাদ্য গ্রহণ করলে হাড়ের গঠন মজবুত হয় এবং উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণযুক্ত খাবার নিশ্চিত করা জরুরি। নিচে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হলো, যা শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।

১. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

প্রোটিন শিশুদের কোষ ও টিস্যুর গঠনে সাহায্য করে এবং নতুন কোষ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রোটিন অপরিহার্য।

যেসব খাবারে প্রোটিন বেশি থাকে:

  • ডিম: ডিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন ডি থাকে, যা হাড় মজবুত করে এবং উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, পনির ইত্যাদিতে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন থাকে, যা হাড়ের গঠনে সহায়ক।
  • মাছ: বিশেষ করে স্যামন, টুনা এবং ইলিশ মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস, যা হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
  • মুরগির মাংস: উচ্চ প্রোটিনযুক্ত এই খাবার শিশুদের পেশি ও হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।
  • ডাল ও বাদাম: মসুর ডাল, ছোলা, কাজু বাদাম, আমন্ড ও চিনাবাদাম উচ্চ প্রোটিনযুক্ত এবং শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক।

২. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার

ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে।

যেসব খাবারে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি বেশি থাকে:

  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ, দই ও পনির খেলে শিশুর হাড় মজবুত হবে।
  • ছোট মাছ: যেমন ইলিশ, কাঁচকি ও ছোট মাছে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে।
  • সূর্যের আলো: সকালবেলা শিশুকে কিছুক্ষণ রোদে রাখলে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
  • ডিমের কুসুম: ডিমের কুসুমে ভিটামিন ডি থাকে, যা শিশুর হাড় শক্তিশালী করে।

৩. আয়রন ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার

আয়রন এবং জিঙ্ক শিশুর বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে এবং জিঙ্ক কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

যেসব খাবারে আয়রন ও জিঙ্ক বেশি থাকে:

  • পালং শাক ও মেথি শাক: এই শাকসবজিতে প্রচুর আয়রন ও অন্যান্য খনিজ রয়েছে, যা শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
  • কলিজা: গরু ও মুরগির কলিজায় প্রচুর আয়রন থাকে, যা শিশুর রক্ত তৈরিতে সহায়তা করে।
  • বিভিন্ন ধরনের বীজ: যেমন চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড, সূর্যমুখী বীজ, যা শিশুর হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
  • বাদাম: কাজু বাদাম, আমন্ড ও আখরোটে জিঙ্ক থাকে, যা শিশুর শরীরের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

৪. স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার

শিশুরা অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করে, তাই তাদের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট থাকা জরুরি।

যেসব খাবারে স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার বেশি থাকে:

  • লাল চালের ভাত ও আটার রুটি: এই খাবারগুলো ধীরে হজম হয় এবং শিশুকে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি যোগায়।
  • শাকসবজি: গাজর, ব্রোকলি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি শাকসবজিতে প্রচুর ফাইবার ও ভিটামিন থাকে, যা শিশুর পেট ভালো রাখে এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
  • ফলমূল: আপেল, কলা, কমলা, আম ইত্যাদি ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

৫. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও হাড়ের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

যেসব খাবারে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ওমেগা-৩ বেশি থাকে:

  • বাদাম ও বীজ: কাজু বাদাম, আখরোট, তিসির বীজ, সূর্যমুখী বীজ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়ক।
  • মাছের তেল: ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছের তেল হাড়ের গঠনে সহায়তা করে।
  • অলিভ অয়েল ও ঘি: রান্নার সময় অলিভ অয়েল বা ঘি ব্যবহার করলে শিশুর শরীরে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের সরবরাহ বাড়ে।

উচ্চতা বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার গুরুত্ব

শুধু পুষ্টিকর খাবার খেলেই হবে না, শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক অনুসরণ করা প্রয়োজন।

১. পর্যাপ্ত ঘুম

  • শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি মূলত রাতের বেলায় হয়, তাই তাদের পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা জরুরি।
  • ৫-১২ বছর বয়সী শিশুদের প্রতিদিন ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।

২. নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা

শিশুদের প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলার মাধ্যমে বৃদ্ধি ভালো হয়।

  • লাফানো ও ঝুলে থাকা ব্যায়াম: দড়ি লাফ, বাস্কেটবল, হ্যাংগিং এক্সারসাইজ উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
  • সাইকেল চালানো ও সাঁতার কাটা: এই ব্যায়ামগুলো পেশি ও হাড়কে মজবুত করে।
  • যোগব্যায়াম: কিছু যোগাসন, যেমন তাড়াসন, ভুজঙ্গাসন উচ্চতা বৃদ্ধিতে কার্যকরী।

শেষ কথা

শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধিতে জিনের ভূমিকা থাকলেও, পুষ্টিকর খাবার ও সঠিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে তাদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব। তাই, শিশুর খাদ্য তালিকায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন এবং তাদের নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।

 

শিশুর ওজন বৃদ্ধির উপায়: পুষ্টিকর খাবার ও জীবনযাত্রা

 

শিশুর সুস্থভাবে ওজন বৃদ্ধি করা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিশুই স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে বেড়ে ওঠে, যা পুষ্টির অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে হতে পারে। শিশুর ওজন বাড়ানোর জন্য শুধু বেশি খাওয়ালেই হবে না, বরং সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। নিচে কিছু কার্যকরী উপায় দেওয়া হলো, যা শিশুর ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে।

 

১. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো

প্রোটিন শিশুদের পেশি ও টিস্যুর বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে, যা স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন বাড়াতে সহায়তা করে।

যেসব খাবারে প্রোটিন বেশি থাকে:

  • ডিম: প্রতিদিন একটি বা দুটি ডিম খাওয়ালে শিশুর ওজন বৃদ্ধি পাবে।
  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, পনির, ছানা শিশুর শরীরে প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে।
  • মুরগির মাংস ও মাছ: উচ্চ প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার শিশুর ওজন বাড়ায়।
  • ডাল ও বাদাম: ছোলা, মসুর ডাল, কাজু বাদাম, আমন্ড ও চিনাবাদাম উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার।

২. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যুক্ত করা

ওজন বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর ফ্যাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব খাবারে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বেশি থাকে:

  • ঘি ও মাখন: পরিমিত পরিমাণে ঘি বা মাখন শিশুর খাবারে যোগ করলে দ্রুত ওজন বাড়ে।
  • অলিভ অয়েল ও নারকেল তেল: রান্নার সময় এগুলো ব্যবহার করলে শিশুর শরীরে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের যোগান বাড়বে।
  • বাদাম ও বীজ: কাজু বাদাম, আখরোট, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী বীজ শিশুর শক্তি ও ওজন বাড়াতে সাহায্য করে।

 

৩. কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো

শিশুরা দ্রুত শক্তি ব্যয় করে, তাই তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট অপরিহার্য।

যেসব খাবারে স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে:

  • ভাত ও আটার রুটি: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাত ও রুটি খেলে শিশুর ওজন বাড়বে।
  • আলু ও মিষ্টি আলু: উচ্চ কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ হওয়ায় ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • শাকসবজি ও ফল: গাজর, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, কলা, আম, পেঁপে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে।

 

৪. বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ানো

কম ওজনের শিশুদের জন্য বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব খাবারে বেশি ক্যালোরি থাকে:

  • কলার মিল্কশেক বা স্মুদি: কলার সাথে দুধ, মধু ও বাদাম মিশিয়ে খাওয়ালে ওজন বাড়বে।
  • মধু ও খেজুর: সকালে ২-৩টি খেজুর ও ১ চামচ মধু খাওয়ানো যেতে পারে।
  • চিকেন বা ফিশ স্যুপ: এটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

 

৫. নিয়মিত ও পরিমিত খাবার খাওয়ানো

অনেক শিশু একবারে বেশি খেতে চায় না, তাই বারবার পরিমিত খাবার খাওয়ানো জরুরি।

  • দিনে ৫-৬ বার ছোট ছোট মিল দেওয়া উচিত।
  • শিশুর প্লেটে সুষম খাবার (প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট) থাকতে হবে।
  • খাবার খাওয়ানোর সময় শিশুর সাথে বসে খেলে সে আগ্রহী হয়ে খেতে পারে।

 

৬. পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার দেওয়া

শিশুর শরীর হাইড্রেটেড থাকলে তার হজম শক্তি ভালো থাকবে এবং খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারবে।

  • দুধ, ফলের রস ও স্মুদি খাওয়ানো উচিত।
  • সাদা পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে।

 

৭. শারীরিক ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা

শুধু খাওয়ালেই হবে না, শিশুদের শারীরিক কার্যক্রমও প্রয়োজন।

  • নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়াম করানো: এতে ক্ষুধা বাড়ে এবং খাবার ভালোভাবে হজম হয়।
  • রাতে ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো নিশ্চিত করা: পর্যাপ্ত ঘুম শিশুর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

 

শেষ কথা

শিশুর ওজন বৃদ্ধি একটি ধীর প্রক্রিয়া। ধৈর্য ধরে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করলে শিশুর ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।

 

শিশুর মেধা বিকাশের জন্য কিছু ভালো অভ্যাস

 

 

শিশুর মেধা বিকাশের জন্য কিছু ভালো অভ্যাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস উল্লেখ করা হলো:

১. পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা

  • নিয়মিত বই পড়তে উৎসাহ দিন: গল্পের বই, জ্ঞানমূলক বই এবং সৃজনশীল বিষয় পড়ার অভ্যাস শিশুর কল্পনাশক্তি ও চিন্তাশক্তি বাড়ায়।
  • বাড়িতে পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন: শিশু যেন মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারে, সেজন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করুন।

২. সৃজনশীল ও কৌতূহলী হওয়া

  • প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তুলুন: শিশুকে নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে উৎসাহ দিন।
  • সৃজনশীল কাজে যুক্ত করুন: আঁকা, গান, নাচ, কবিতা লেখা বা কুইজ খেলায় অংশ নিতে দিন।

৩. খেলাধুলা ও শারীরিক ব্যায়াম

  • নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করান: দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।
  • বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা খেলতে দিন: পাজল, দাবা, লুডু, গণিতের খেলা বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়।

৪. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ

  • মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাবার দিন: বাদাম, দুধ, ডিম, মাছ, শাকসবজি, ফল, এবং পর্যাপ্ত পানি পান করান।
  • চিনি ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন: এগুলো শিশুর মনোযোগ কমিয়ে দিতে পারে।

৫. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা

  • রাতে ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য জরুরি।
  • স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন: বেশি মোবাইল বা টিভি দেখলে মনোযোগ কমে যেতে পারে।

৬. সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া

  • বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিন: এতে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়বে।
  • সততা, ধৈর্য, ও সহমর্মিতা শেখান: এগুলো বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি আবেগীয় বুদ্ধি (EQ) উন্নত করে।

৭. নতুন কিছু শেখার সুযোগ দেওয়া

  • একাধিক ভাষা শেখাতে পারেন: এটি স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাশক্তি বাড়ায়।
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ তৈরি করুন: বিভিন্ন মজার পরীক্ষা ও আবিষ্কারের গল্প বলুন।

এই অভ্যাসগুলো শিশুর বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

 

শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঘরোয়া উপায়

 

 

শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা, যা মূলত খাবারে ফাইবারের অভাব, পানিশূন্যতা বা অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে হতে পারে। এটি শিশুদের অস্বস্তি সৃষ্টি করে এবং খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করলে সহজেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।

১. পানির পরিমাণ বাড়ানো

শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে মল কঠিন হয়ে যায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।

করণীয়:

  • শিশুকে পর্যাপ্ত গরম বা কুসুম গরম পানি পান করানো।
  • ফলের রস, ডাবের পানি বা স্যুপ খাওয়ানো যেতে পারে।
  • ছোট শিশুর জন্য মায়ের দুধ বেশি করে খাওয়ানো।

২. আঁশযুক্ত (ফাইবার সমৃদ্ধ) খাবার খাওয়ানো

ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার হজমে সাহায্য করে এবং মল নরম রাখে।

যেসব খাবার কার্যকর:

  • ফল: পাকা কলা, পেঁপে, আপেল, নাশপাতি, কমলা, আঙুর
  • শাকসবজি: পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর
  • ডাল ও শস্যজাতীয় খাবার: ওটস, লাল চালের ভাত, ছোলা, মসুর ডাল
  • বাদাম ও বীজ: চিয়া সিড, ফ্লাক্স সিড (তবে ১ বছরের নিচের শিশুকে বাদামজাতীয় খাবার খাওয়ানোর আগে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত)

৩. গরম দুধ ও মধু খাওয়ানো

গরম দুধ হজমশক্তি বাড়ায় এবং মল নরম করে।

করণীয়:

  • এক গ্লাস গরম দুধের সাথে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে (১ বছরের বেশি বয়স হলে)।
  • রাতে ঘুমানোর আগে খাওয়ালে সকালে সহজেই মলত্যাগ হতে পারে।

৪. তেল বা ঘি মেশানো খাবার দেওয়া

তেল ও ঘি প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং মল নরম রাখে।

করণীয়:

  • শিশুর খাবারে পরিমিত পরিমাণে ঘি বা অলিভ অয়েল যোগ করা।
  • আলু ভর্তা, ডাল বা রুটির সাথে সামান্য তিলের তেল বা সরিষার তেল মিশিয়ে খাওয়ানো।

৫. পাকা কলা ও পেঁপে খাওয়ানো

এই দুটি ফল প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ (মল নরমকারক) হিসেবে কাজ করে।

করণীয়:

  • প্রতিদিন ১টি পাকা কলা খাওয়ালে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে।
  • পাকা পেঁপে হজমে সাহায্য করে ও মল নির্গমন সহজ করে।

৬. ইসবগুলের ভুষি ব্যবহার করা (বয়স অনুযায়ী)

ইসবগুলের ভুষি মল নরম করে ও সহজে নির্গমন করতে সাহায্য করে।

করণীয়:

  • ১ বছরের বেশি বয়সী শিশুর জন্য কুসুম গরম দুধ বা পানির সাথে অল্প ইসবগুলের ভুষি মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।

 

৭. মালিশ ও ব্যায়াম করানো

শিশুর শরীরে হালকা ম্যাসাজ করলে অন্ত্রের নড়াচড়া স্বাভাবিক হয় এবং মল সহজে বের হতে সাহায্য করে।

করণীয়:

  • গরম সরিষার তেল বা নারকেল তেল দিয়ে শিশুর পেটে হালকা মালিশ করা।
  • শিশুকে হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলা করানো (তাতে অন্ত্রের নড়াচড়া স্বাভাবিক থাকে)

৮. টয়লেট ট্রেনিং ও অভ্যাস গঠন

অনেক শিশু দীর্ঘক্ষণ মল ধরে রাখে, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ।

করণীয়:

  • শিশুকে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে মলত্যাগে উৎসাহিত করা।
  • বাচ্চাকে মলত্যাগের জন্য চাপ দিতে বাধ্য না করা, বরং স্বাভাবিকভাবে বসার অভ্যাস করানো।
  • টয়লেটের প্রতি ভীতি দূর করতে তাকে ধৈর্য ধরে বোঝানো।

৯. কাঁচা দই বা প্রোবায়োটিক খাবার দেওয়া

দইয়ের ভালো ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও হজমশক্তি বাড়ায়।

করণীয়:

  • ১ বছরের বেশি বয়স হলে প্রাকৃতিক কাঁচা দই খাওয়ানো যেতে পারে।
  • নিয়মিত দই খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমবে।

⚠️ কখন ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন?

যদি –
✅ শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য ৫-৭ দিনেও না কমে।
✅ মলের সাথে রক্ত আসে।
✅ প্রচণ্ড পেটব্যথা বা বমি হয়।
✅ শিশু খেতে চায় না বা সবসময় ক্লান্ত থাকে।

এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শেষ কথা

শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তবে নিয়মিত সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করলে সহজেই এটি দূর করা সম্ভব। পানি, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, ব্যায়াম ও সঠিক অভ্যাস শিশুকে সুস্থ রাখবে।

 

ডায়াবেটিস কী এবং এ রোগ কেন হয়

ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস (Diabetes) হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি (Chronic) রোগ, যেখানে শরীরের রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এটি ইনসুলিন হরমোনের সমস্যা বা অকার্যকারিতার কারণে ঘটে।

  • ইনসুলিন হলো অগ্ন্যাশয় (Pancreas) থেকে নিঃসৃত একটি হরমোন, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং এটি কোষে পৌঁছে দেয় শক্তি উৎপাদনের জন্য।
  • ডায়াবেটিস হলে শরীর হয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অথবা উৎপন্ন ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট, কিডনি, চোখ ও স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে।

ডায়াবেটিস কেন হয়?

ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ ইনসুলিনের ঘাটতি বা অকার্যকারিতা। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন—

১. জেনেটিক্স বা বংশগত কারণ

  • পরিবারে যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • বিশেষত টাইপ-১ ডায়াবেটিস সাধারণত বংশগত কারণে হয়ে থাকে।

২. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

  • অতিরিক্ত চিনি ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বেশি খেলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
  • প্রসেসড ফুড, সফট ড্রিংকস, জাঙ্ক ফুড বেশি খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

৩. স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন

  • অতিরিক্ত ওজন হলে শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা (Insulin Sensitivity) কমে যায়, ফলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়।
  • পেটের চারপাশে বেশি চর্বি থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়

৪. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা (ব্যায়ামের অভাব)

  • পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করলে শরীর ইনসুলিনকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, ফলে রক্তে শর্করা জমে।
  • নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

৫. মানসিক চাপ ও ঘুমের সমস্যা

  • দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ কর্টিসল (Cortisol) হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ইনসুলিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

৬. হরমোনজনিত সমস্যা

  • পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে।

৭. কিছু ওষুধ ও মেডিকেল অবস্থার প্রভাব

  • কিছু স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে রক্তে শর্করা বাড়াতে পারে।
  • দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে

উপসংহার

ডায়াবেটিস সাধারণত ইনসুলিনের ঘাটতি বা অকার্যকারিতার কারণে হয়। বংশগত কারণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ব্যায়ামের অভাব, মানসিক চাপ, হরমোনের সমস্যা ও কিছু ওষুধ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে এই রোগ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

 

হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ জীবনাচরণ

হৃদরোগ বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। তবে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস রপ্ত করতে পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। নিচে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ জীবনাচরণ দেওয়া হলো যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

১. সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায়। খাদ্যতালিকায় নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:

  • প্রচুর পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খান, কারণ এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়।
  • পূর্ণ শস্য (যেমন লাল চাল, ওটস, গমের রুটি) গ্রহণ করুন, যা হার্টের জন্য উপকারী।
  • স্বাস্থ্যকর চর্বি (যেমন অলিভ অয়েল, বাদাম, চিয়া সিড) খাওয়া উচিত এবং ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট এড়িয়ে চলা জরুরি।
  • পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করুন, বিশেষত মাছ, মুরগি, ডাল এবং দুধজাত খাবার থেকে।
  • অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন

শারীরিক পরিশ্রম হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন
  • সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট তীব্র মাত্রার ব্যায়াম করুন।
  • যোগব্যায়াম, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা বা দৌড়ানোর মতো কার্যক্রম হার্ট সুস্থ রাখে।
  • বসে থাকার সময় কমিয়ে দিন এবং অফিস বা বাসায় মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করুন।

৩. ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন

ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন হার্টের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

  • ধূমপান ধমনী সংকীর্ণ করে, যা হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • অ্যালকোহল উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
  • ধূমপান ছাড়ার পর কয়েক মাসের মধ্যেই হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা উন্নত হতে শুরু করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি কমে যায়।

৪. ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন

সঠিক ওজন বজায় রাখা হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য।

  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার, ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি।
  • রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন এবং কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৫. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন

অতিরিক্ত মানসিক চাপ হৃদরোগের অন্যতম কারণ হতে পারে।

  • প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
  • ধ্যান ও যোগব্যায়াম মানসিক চাপ কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
  • সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও ইতিবাচক চিন্তা করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • মানসিক চাপ থাকলে প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান, হাঁটাহাঁটি করুন বা গান শুনুন।

উপসংহার

সুস্থ জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, ব্যায়াম, ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা, ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা—এই পাঁচটি জীবনাচরণ মেনে চললে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখন থেকেই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি, কারণ সুস্থ হৃদয়ই সুখী জীবনের চাবিকাঠি!

হৃদরোগ কী এবং এ রোগ কেন হয়

হৃদরোগ কী?

হৃদরোগ (Heart Disease) হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। এটি মূলত হৃদযন্ত্রের রক্তনালীগুলোর (Coronary Arteries) ব্লকেজ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের পাম্পিং ক্ষমতার দুর্ব

লতা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি কারণে হয়ে থাকে।

হৃদরোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন—

  1. করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) – হার্টের ধমনী ব্লক হয়ে রক্ত প্রবাহ কমে যায়।
  2. হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction) – রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে হয়।
  3. হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতা (Heart Failure) – হার্ট দুর্বল হয়ে রক্ত পাম্প করতে পারে না।
  4. অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia) – হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত বা ধীর হয়।
  5. ভালভের সমস্যা (Valvular Heart Disease) – হার্টের ভালভ ঠিকভাবে কাজ না করলে হয়।

হৃদরোগ কেন হয়?

হৃদরোগ হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—

১. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)

  • উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হৃদযন্ত্রকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়, ফলে ধমনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • এটি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়

২. কোলেস্টেরল ও ধমনির ব্লকেজ

  • LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) বেশি হলে এটি ধমনিতে জমে প্লাক তৈরি করে, ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
  • রক্তনালী সংকীর্ণ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক ও এনজাইনার ঝুঁকি বাড়ে

3. ডায়াবেটিস (Diabetes)

  • ডায়াবেটিস থাকলে রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হার্টের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

4. স্থূলতা (Obesity) ও অতিরিক্ত ওজন

  • বেশি ওজন হলে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • পেটের চারপাশে বেশি চর্বি থাকলে হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়

5. ধূমপান ও অ্যালকোহল

  • নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড ধমনিগুলোর ক্ষতি করে এবং ব্লকেজ সৃষ্টি করে।
  • অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

6. মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা

  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ কর্টিসল (Cortisol) হরমোন বাড়িয়ে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন অনিয়মিত করে।
  • দীর্ঘমেয়াদে এটি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়

7. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা (Exercise-এর অভাব)

  • ব্যায়াম না করলে হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং কোলেস্টেরল জমতে থাকে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ করে।

8. জেনেটিক্স ও বয়সজনিত কারণ

  • পরিবারে কারও হৃদরোগ থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়
  • বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধমনিগুলো শক্ত হয়ে যায়, ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ে।

উপসংহার

হৃদরোগ প্রধানত উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ধূমপান, মানসিক চাপ ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার, ধূমপান পরিহার ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

শিশুদের মেধা বিকাশে দই এর অনন্য ভূমিকা

 

 

 

যদি জিজ্ঞেস করি আপনার সন্তানকে নিয়ে একটা আশার কথা বলেন। আপনি বলবেন আমার সন্তান যেন মেধাবী হয়। কেননা আজ সারাদেশে, সারাবিশ্বে মেধাবী মানুষদের জয়জয়কার। হুমায়ুন আহমেদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে হালের সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল এবং আরো অনেক আলোকিত মানুষ তাদের মেধা দিয়ে আমাদের দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। 

 

এই মেধার বিকাশের একটা বড় অংশ কিন্তু ঘটে ছেলেবেলায়। বিশেষ করে ২ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। মানুষের ব্রেইনের একটা বড় উন্নতিপর্ব এই সময়টাতে ঘটে যায়। এ সময়টা তাই আপনার সন্তানের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন অভিভাবক হিসেবে আপনার তাই জানা প্রয়োজন এমন সব খাবার সম্পর্কে যা আপনার সন্তানের মেধা বিকাশের জন্য সহায়ক। সে রকম একটা সহজপ্রাপ্য, সুস্বাদু এবং সাশ্রয়ী খাবার হল দই।

 

মূল আলোচনায় যাবার আগে মেধা নিয়ে একটা পরিস্কার ধারণা নেয়া প্রয়োজন। মেধাবী মানুষ মানে কি সেই মানুষ  যিনি খুব ভাল রেজাল্ট করেন? আসলে কিন্তু তা নয়। মেধাবী মানুষ মানে মানে সেই মানুষ যিনি ধীশক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, প্রত্যুতপন্নমতি এবং বিবেকবান। আর এর সবটাই নির্ভর করে আমাদের মস্তিষ্ক কতটা উন্নত ও ধারালো তার ওপরে।

চলুন তবে দেখি দই এর মধ্যে থাকা নানা খাদ্যোপাদানের মস্তিষ্কের উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবার ক্ষমতা রয়েছে কিনা। 

 

দই এ রয়েছে অতি উচ্চমাত্রার প্রবায়োটিক। এই প্রবায়োটিক আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। অন্ত্রের এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের ব্রেইন এর কার্যক্ষমতা বাড়াতে সরাসরি কাজ করে। কাজেই দই খেলে প্রবায়োটিক এর মাধ্যমে ব্রেইন এর ক্ষমতা সংগত কারনেই বেড়ে যায়। 

 

মেধাবী বাচ্চাদের একটা বড় গুন হল মনে রাখতে পারা আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারা। দই এই দুটোই অর্জন করতে সাহায্য করতে পারে। দই এ আছে ভাল ব্যাকটেরিয়া যা আমাদের দেহের প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন কমাতে সাহায্য করে এবং নিউরণগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংযোগ সাধনে ভূমিকা রাখে। এই দুটো ব্যাপার ঘটার মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের মনে রাখা ও মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়ে যায়। 

 

দেখেবেন কিছু বাচ্চা একটা কিছু বললে চট করে ধরে ফেলে। এটা করতে পারে তার বেইনের নিউরাল কানেকশন বা আন্ত নিউরণ যোগাযোগ ক্ষমতা বেশি থাকে বলে। ব্যাপারটা অনেকটা সুইচ চাপলে বাতি জ্বলে ওঠার মতো। তো দই এ থাকা এমাইনো এসিড, প্রোটিন এবং ভিটামিন বি নিউরনের মধ্যকার এ সংযোগ সাধনকে ত্বরান্বিত করে। 

 

মেধাবী বাচ্চারা কেবল মনোযোগী হয় না তারা স্বটা ধরেও রাখতে পারে অনেক্ক্ষণ ধরে। এর একটা কারণ কিন্তু তাড়াতাড়ি ক্লান্ত ও হতোদ্যম হয়ে পড়া। দই  খেলে বাচ্চারা সহজে ক্লান্ত হয় না এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়৷ ফলত তারা মেধাবী হয়ে ওঠে। 

 

অনেক বাচ্চারা দেখবেন অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। মেধাবী বাচ্চারা কিন্তু এমন হয় না। তারা ধীরস্থির থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়। দই আপনার বাচ্চার কর্টিসল হরমোন যা এক ধরনের নারেভাস হরমোন, একে সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে সাহায্য করে। এর ফলে আপনার বাচ্চা অযথা প্রেসাব ফিল করে না এবং শান্ত থাকতে পারে। 

 

ছাড়াও নিয়মিত দই খেলে আপনার বাচ্চার সার্বিক দৈহিক ও মানসিক উন্নতি আর দশটা সাধারণ বাচ্চার চেয়ে অনেকাংশেই ত্বরান্বিত হয়। 

 

তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, ওপরে বর্ণিত উপকার গুলো কেবল দই খেয়ে পাওয়া যাবে না যদি না পারিপার্শ্বিক স্থবিরতা, আদর্শ শিক্ষণ পরিবেশ, শিক্ষক এবং অভিভাবকের সহায়তা এবং সুশৃংখল জীবনযাপন এর অভ্যাস পাশাপাশি গড়ে তোলা না যায়। 

আপনার বাচ্চার মেধার বিকাশে এ আর্টিক্যালটি সামান্যতম কাজে আসলেও আমরা দারুণ বোধ করব। হ্যাপি প্যারেন্টিং!  

 

এ সংক্রান্ত আরো বিষয়াদি জানতে পড়ুন……

শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দই এর অসাধারণ ভূমিকা

শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দই এর অসাধারণ ভূমিকা

বাবা মায়ের কাছে সুন্তানের সুস্থ ও নীরোগ দেহের চেয়ে বোধ করি পরম কাঙ্ক্ষিত জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই। সে কারনেই আপনি চান তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন ইস্পাত দৃঢ় হয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্মগতভাগেই রোগ প্রতিরোধ এর বেসিক সক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তবে আমরা যদি এর যত্ন না নিই বা একে উন্নত করতে  সচেষ্ট না হই তবে তা আমাদের অনেক ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকে হয়তো রক্ষা করতে পারবে না। 

 

তবে আশার কথা হচ্ছে এমন কিছু খাবার আছে সেগুলো যদি আপনার  সন্তানের পাতে দিতে পারেন তবে ওর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হবে অসামান্য। আজ সেরকম একটা খাবারের কথাই বলব। সেটা হল দই সহজলভ্য, সুস্বাদু এবং সাশ্রয়ী। অথচ এমন সব গুণে ভরা যা জেনে আপনি হয়তো  অবাক হয়ে যাবেন। 

 

আসুন তবে জেনে নিই কেন এবং কিভাবে আপনার সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দই অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। 

 

১. বিজ্ঞান বলে গাট হেলথ বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকবে। আর দই কে বলা হয় সে অন্ত্রের মন্ত্র। ল্যাকটোবেসিলাস ও বিফিডোবেক্টেরিয়াম নামের দুটো উপকারী ব্যাক্টেরিয়া আছে দইয়ে। এই দুটো ব্যাক্টেরিয়া আপনার সন্তানের অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকলাপ সচল রাখে। গবেষণা বলে অন্ত্র ভাল থাকলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজে থেকেই ৭০% ভাল থাকবে। এর ফলে দই খেলে পরোক্ষভাবে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। 

 

২. দই এ আছে এমাইনো এসিড, প্রোটিন, জিংক, ভিটামিন ডি এর মত অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। প্রোটিন আপনার বাচ্চার ইমিউনো সেলস এর উন্নতিতে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ কমিয়ে রগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, জিংক এর ক্ষমতা আছে ইনফেকশন কমিয়ে দেয়ার আর তা ঘটে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবার ফলে। 

 

৩. ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা শরীরে ভাল থাকলে সেটা আপনার সন্তানকে সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করবে। দই এ থাকা প্রোবায়োটিক প্রদাহ কমিয়ে এনে সংক্রামক রোগ বালাই থেকে আপনার সন্তানকে রক্ষা করতে দারুণভাবে সাহায্য করে। 

 

৪. আপনি যা খাবেন তা যদি ভালোভাবে শরীরে না প্রবেশ করে বা হজম না হয় তবে কিন্তু সবই গেল! দইয়ে থাকা উপকারী ব্যাক্টেরিয়া অন্ত্রের কার্যক্রম বাড়িয়ে দিয়ে খাবার হজম করার প্রক্রিয়া সহজ করে দেয়। এর ফলে যেটা হয় সকল খাদ্যোপাদান আমাদের শরীরে সুন্দর করে শোষিত হয় এবং আমরা নীরোগ থাকি। 

 

৫. দইয়ে থাকে ভিটামিন বি ১২। গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন বি রোগ প্রতিরধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। 

 

৬. দই এ থাকা প্রোবায়োটিক শরীরে থাকা টক্সিন বা বর্জ্য অপসারণে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এর ফলে আমাদের বিপাক এবং হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে। আর হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। 

 

মোটা দাগে এটা বলা যেতে পারে যে, দই এ থাকা নানা গুরুত্বপূর্ন খাদ্যোপাদান এবং ভাল ব্যাক্টেরিয়া তথা প্রোবায়োটিক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আপনার সন্তানের  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভীষণ দরকারী ভূমিকা পালন করে।    

 

তবে পাশাপাশি এটাও মনে রাখা জরুরি যে সঠিক জীবনাচরণ, ব্যায়াম, নিদ্রা এবং নিয়মানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতা না থাকলে কেবল পুষ্টিকর খাবার আপনার বাচ্চাকে নীরোগ রাখতে যথেষ্ট হবে না। এরজন্য দরকার সমন্বিত প্রয়াস৷ তবে দই এর মত খাবারগুলো এ প্রয়াসকে সার্থক করতে পারে অনেকাংশে।